লোগাং হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারের দাবিতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের স্মারকলিপি

May 9, 2025

By: pcpchtor

১০ই এপ্রিল ৯২ লোগাং গুচ্ছগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর যোগসাজসে সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারের দাবিতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের স্মারকলিপি

সমীপে,

মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

ঢাকা, বাংলাদেশ।

 

মহাশয়া,

আমরা অতি দুঃখ ও বেদনার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র সমাজ তথা নিপীড়িত-নির্যাতিত পাহাড়ী জনগণের পক্ষ হয়ে ১০ই এপ্রিল ‘৯২ খাগড়াছড়ি জেলাধীন পানছড়ি উপজেলার লোগাং গুচ্ছগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর যোগসাজসে সংঘটিত স্মরণাতীতকালের ভয়াবহতম হত্যাযজ্ঞের প্রতি আপনার এবং আপনার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও বহু মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার পর আমরা আশা করেছিলাম স্বাধীন দেশে আমরা সবার মতো মান-মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবো। প্রতিটি উন্নয়ন কর্মকান্ড ও দেশ গড়ার কাজে আমরাও গর্বের সাথে অংশ নিতে পারবো। স্বাধীন দেশে আমাদের আর কেউ লাঞ্ছিত করতে পারবে না। আমাদের আর গ্লানিময় জীবন নিয়ে কাল অতিবাহিত করতে হবে না। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, স্বাধীনতার একুশ বছর পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের সহজ সরল পাহাড়ীদের আশা-আকাংখা বিন্দুমাত্র পূরণ হয়নি। আজও পাহাড়ীদের বুকে রক্ত ঝরা বন্ধ হয়নি, আজো পাহাড়ের বুকে মানুষের কান্নার রোল থামেনি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত পাহাড়ীদের হত্যা, গুম, নারী নির্যাতন, জায়গা-জমি জবর দখল, ঘর-বাড়ী পুড়িয়ে দেয়া, বসতবাড়ী থেকে উচ্ছেদ করা, সহায় সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করা, জোরপূর্বক মানুষ-জনকে গুচ্ছগ্রামে বন্দী করা ও বিনাদোষে নিরপরাধ লোকজনকে ধরে নিয়ে সেনাক্যাম্পে অমানুষিক নির্যাতন চালানো নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনে দিনে এই অত্যাচার উৎপীড়নের মাত্রা বেড়েই চলেছে। পাহাড়ীদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়েছে।

পাহাড়ী জনগণকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য ১৯৮০ সালের কলমপতি হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে এযাবত ১৪/১৫টি বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডে হাজার হাজার নিরীহ জনসাধারণ খুন হয়েছে। অগণিত লোকজন গুরুতর আহত হয়ে জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে। সহায় সম্বল হারিয়ে হাজার হাজার লোক জীবনের শেষ আশ্রয়ের সন্ধানে বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী জনগণের জীবনে প্রতিটি হত্যাকাণ্ড এক একটি কালো অধ্যায়। সম্প্রতি ১০ই এপ্রিল ‘৯২ এই কালো তালিকায় যুক্ত হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহতম, বিভীষিকাময় ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড যা ভিয়েতনাম মাইলাই হত্যাকাণ্ডকেও ছাড়িয়ে গেছে। ঐদিন খাগড়াছড়ি জেলাধীন পানছড়ি উপজেলার লোগাং গুচ্ছগ্রামে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে প্রায় ১২ শত লোক নিহত হয়েছে। ৭ শতাধিক ঘর-বাড়ী ভস্মিভূত হয়েছে। ডেপুটি এটর্নি জেনারেল সহ বৈ-সা-বি (বৈসুক-সাংগ্রাই-বিজু) উৎসব উপলক্ষে সাংবাদিক, শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতাদেরকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঐ এলাকা পরিদর্শন করতে দেয়নি। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পাহাড়ী জনগণ তাদের মহান বৈ-সা-বি উৎসব বর্জন করে সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার লোক বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে এবং উক্ত ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবীতে খাগড়াছড়ি জেলার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাবরে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেছে।

জানা যায়, ঘটনার দিন লোগাং গুচ্ছগ্রাম থেকে তিন জন পাহাড়ী যুবতী মাঠে গরু চড়াতে গেলে পার্শ্ববর্তী বাঙালী অধ্যুষিত গুচ্ছগ্রাম থেকে কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক জোরপূর্বক তাদের ধর্ষণের চেষ্টা করে। পাহাড়ী যুবতীরা দা’ দিয়ে নিজেদের আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করলে একজন বাঙালী আহত হয় এবং পরে রক্তক্ষরণের ফলে মারা যায়। উক্ত অনুপ্রবেশকারী বাঙালীরা এই ঘটনাকে শান্তিবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হয়েছে বলে সেনা ক্যাম্পে মিথ্যাভাবে রিপোর্ট করে। এরপর সঙ্গে সঙ্গে অনুপ্রবেশকারী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা যৌথভাবে লোগাং গুচ্ছগ্রামে আক্রমণ করে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গুচ্ছগ্রামবাসীদের উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে এবং অনুপ্রবেশকারীরা রামদা, কুড়াল, খন্তা, বর্শা প্রভৃতি ধারালো অস্ত্র দিয়ে পাহাড়ীদের উপর চড়াও হয়। তারা লোকজনদেরকে ঘরে আটকিয়ে রেখে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব আজ বিপদাপন্ন, হুমকীর সম্মুখীন। লোগাং গুচ্ছগ্রামের এই হত্যাকাণ্ড অস্তিত্ব প্রশ্নে পাহাড়ী জনগণকে আরো অত্যধিক আতংকগ্রস্ত করে তুলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের দশ ভিন্ন ভাষা-ভাষী পাহাড়ী জনগণও তাদের স্ব স্ব ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, প্রথা, ইতিহাস তথা স্বকীয় জাতীয় অস্তিত্ব নিয়ে দেশের অপরাপর অঞ্চলের জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে শরীক হতে চায়। এই লক্ষ্যে পাহাড়ী জনগণও এরশাদ সরকারের সামরিক স্বৈরশাসনসহ সকল প্রকার নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করেছে। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা, অত্যাচার-উৎপীড়ন সহ্য করেছে।

দেশ আজ সামরিক স্বৈরশাসনমুক্ত। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে একটি সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনগণের রায় নিয়ে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি গণতান্ত্রিক সরকার। এই গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে পূর্বের স্বৈরাচারী আমলের মতো আমাদের উপর অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার ও জুলুম আমরা আশা করি না। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য পার্বত্য চট্টগ্রামে আজো আগের মত অত্যাচার-উৎপীড়ন চলছে।

সম্প্রতি ১০ই এপ্রিল ‘৯২ লোগাং হত্যাকাণ্ড আমাদেরকে উদ্বিঘ্ন করে তুলেছে। আমরা আজ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। অচিরেই এই হত্যাকাণ্ডের বিহীত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা নিলেক্ত দাবী পেশ করছি:

১। লোগাং হত্যাকাণ্ডসহ এযাবত পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার বিভাগীয় তদন্ত, শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং দোষী ব্যক্তিদের আইনানুগ শাস্তি প্রদান করতে হবে।

২। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের জন্য সংসদীয় কমিটি গঠন করতে হবে এবং সকল প্রকার অনুসন্ধানী দল ও সাংবাদিকদের সফরের অবাধ সুযোগ দিতে হবে।

৩। ভবিষ্যতে যাতে এরূপ মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত না হয় তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

৪। উক্ত হত্যাকাণ্ডসহ এ যাবত পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং গুচ্ছগ্রাম ভেঙে দিয়ে স্ব স্ব জায়গা-জমিতে পুনর্বাসন করতে হবে।

৫। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের পাঁচ দফা বাস্তবায়ন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে।

তারিখ: ২৯ শে এপ্রিল ১৯৯২ ইং, ঢাকা।