পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষা করতে এগিয়ে আসুন!
সম্প্রতি খাগড়াছড়ি জেলাধীন পানছড়ি উপজেলার লোগাং গুচ্ছগ্রামে সংঘটিত ব্যাপক গণহত্যা সহ পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের প্রেক্ষিতে দেশবাসী তথা বিশ্ববিবেকের কাছে একটি জরুরী আবেদনঃ
প্রিয় দেশবাসী,
পার্বত্য চট্টগ্রামের লক্ষ লক্ষ পাহাড়ী জনগণ আজ শোকে মুহ্যমান। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী জনগণকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য তাদের ওপর চালানো হচ্ছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। সম্পতি পাহাড়ী জাতিসত্তাসমূহের মহান বৈসাবি চৈত্রসংক্রান্তির দুইদিন পূর্বে গত ১০ই এপ্রিল ‘৯২ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার লোগাং গুচ্ছগ্রামে মানবেতিহাসের সমস্ত বর্বরতাকে ছাড়িয়ে সংঘটিত হয়েছে এক ভয়াবহ ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। এই মধ্যযুগীয় বর্বর হত্যাকাণ্ডকে নিন্দা করার ভাষা আমাদের জানা নেই। পার্বত্যাঞ্চলে তথাকথিত শান্তি শৃংখলা ও নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় সংঘটিত এই পৈশাচিক হামলায় বার শতাধিক নিরীহ পাহাড়ী নির্মমভাবে নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অগণিত। নিখোঁজ রয়েছে অসংখ্য। সহস্রাধিক ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে ঐ এলাকাকে শ্মশানে পরিণত করা হয়েছে। প্রাণের ভয়ে পালিয়ে গেছে হাজার হাজার লোক। পানছড়ি উপজেলার উক্ত লোগাং এলাকায় এখনো কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। দুর্ভেদ্য সেনাবেষ্টনী দিয়ে সমস্ত ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার প্রাণপন চেষ্টা চালানো হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক ঘটনাস্থল থেকে শত শত লাশ ট্রাকে কালো কাপড় ঢেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের ঐতিহাসিক মহান বৈ-সা-বি (বৈসু, সাংগ্রাই, বিঝু) উৎসবে অংশগ্রহণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরের জন্য ঢাকা থেকে আমন্ত্রিত অতিথি বৃন্দকেও পানছড়ি জোন এর মেজর রেজা ঐ এলাকা সফর করতে দেয়নি।
জানা যায় ঘটনার দিন লোগাং গুচ্ছগ্রাম থেকে তিনজন পাহাড়ী যুবতী মাঠে গরু চড়াতে গেলে পার্শ্ববর্তী বাঙালী গুচ্ছগ্রাম থেকে কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক জোরপূর্বক তাদের ধর্ষণের চেষ্টা করে। পাহাড়ী যুবতীরা দাও দিয়ে নিজেদের আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করে। এতে একজন বাঙালী আহত হয় এবং পরে রক্ত ক্ষরণের ফলে মারা যায়। অনুপ্রবেশকারীরা এই ঘটনাকে শান্তিবাহিনী কর্তৃক করা হয়েছে বলে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে মিথ্যাভাবে রিপোর্ট করে। এরপর সঙ্গে সঙ্গে অনুপ্রবেশকারী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা যৌথভাবে লোগাং গুচ্ছগ্রাম আক্রমণ করে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গুচ্ছগ্রামবাসীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করে এবং অনুপ্রবেশকারীরা রামদা, কুড়াল, খন্ডা, বর্শা প্রভৃতি ধারালো অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে ৫০০০ পাহাড়ী অধ্যুষিত লোগাং গুচ্ছগ্রামে এক নারকীয় রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আনন্দ উৎসব বাতিল হয়ে যায়। সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে নেমে আসে শোকের কালো ছায়া। ১২ই এপ্রিল ‘৯২ বিভিন্ন জায়গায় শোক সভা ও মিছিলের মাধ্যমে এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করা হয়। ১৩ই এপ্রিল মূল উৎসবের দিনে হাজার হাজার পাহাড়ী নরনারী বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। অথচ সবাইকে অবাক করে দিয়ে সরকার স্থানীয় ও জাতীয় প্রচার মাধ্যম সমূহের এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য নির্লজ্জভাবে শান্তিবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হয়েছে বলে প্রচার করে (১১ই এপ্রিল ‘৯২)।
উক্ত হত্যাকাণ্ডের সাথে যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে-
১. হাবিলদার জলিল (আনসার সদস্য, ২. সিদ্দিকুর রহমান (আনসার পি.সি), ৩.লোকমান (আনসার), ৪. কেরামত আলী (ভি.ডি.পি), ৫. রাধীকা সাহা (অনুপ্রবেশকারী), ৬. মোহাম্মদ ইদ্রিস মিঞা (অনুপ্রবেশকারী), ৭. মোঃ ইলিয়াস (অনুপ্রবেশকারী), ৮. মোঃ জামশেদ ভূঁইয়া (বর্তমান চেয়ারম্যান এর ভাই), ৯. মঙ্গল মিয়া (অনুপ্রবেশকারী), ১০. কাজী হানিফ (অনুপ্রবেশকারী এবং ইউপি মেম্বার), ১১. সুলতান কাজী (অনুপ্রবেশকারী)।
প্রিয় দেশবাসী,
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী জনগণের ওপর পরিচালিত হত্যাকাণ্ড নতুন কিছু নয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পুনর্বাসিত লক্ষ লক্ষ সমতলবাসী বাঙালীদের লেলিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে ও সহায়তায় পাহাড়ী জনগণকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য একের পর এক সুপরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড চালানো হচ্ছে। লোগাং এর উক্ত হত্যাকাণ্ড ছাড়াও গত ৩০শে মার্চ রাঙ্গামাটি জেলাধীন বালুখালী ইউনিয়নের বসন্ত পাড়া নামক গ্রামে রাজমনি পাড়া ক্যাম্প ও বসন্ত পাড়া ক্যাম্প এর যৌথ উদ্যোগে এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। উক্ত ক্যাম্পদ্বয়ের সেনা সদস্যরা মিতিঙ্গ্যা ছড়ি সাবজোন (কাপ্তাই ব্রিগেড এর অধীন) কমান্ডার মেজর নাসের এর নির্দেশে এবং লেঃ হাবিবের নেতৃত্বে বসন্ত পাড়াতে অবস্থান নেয়। সকাল ৬টা ২০ মিনিটের দিকে তারা নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। ফলে ঘটনাস্থলে চারজন মারা যায়। নিহত ব্যক্তিরা হলেন, সাগর বাসা চাকমা, বুদ্ধ চাকমা, শাড়ি চাকমা ও জ্ঞান রতন চাকমা। নিহত ব্যক্তিদের লাশ ফেরত দেয়া হয়নি। সেনাবাহিনীরা নিজেরাই এই লাশ পুড়ে ফেলে। অথচ এই সত্য ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেয়ার জন্যও জাতীয় দৈনিক সমূহে মিথ্যাভাবে এই নিরীহ ব্যক্তিগণকে শান্তিবাহিনী বলে প্রচার করা হয়েছে (৩১শে মার্চ ৯২)।
প্রিয় দেশবাসী,
আমরাও বাংলাদেশের নাগরিক। এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি রয়েছে আমাদের অগাধ আস্থা। এ দেশের অপরাপর অঞ্চলের জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরাও জাতীয় অগ্রগতিতে সম্পৃক্ত হতে চাই। দেশের সাধারণ নাগরিকের মতো আমরাও নিজস্ব জাতীয় স্বকীয়তা ও ঐতিহ্য নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামের এই দশ ভিন্ন ভাষাভাষী পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য একটি অশুভ কুচক্রীমহল উঠে পড়ে লেগেছে। যখনই আমরা আমাদের স্ব স্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য তথা স্বকীয় জাতীয় অস্তিত্ব নিয়ে এ দেশের জাতীয় মূল স্রোতধারায় সামিল হতে চেয়েছি, ততবারই আমাদের ওপর চালানো হয়েছে অমানুষিক সামরিক দমন-পীড়ন ও নিপীড়ন-নির্যাতন। ১৯৮০ সালের কলমপতি হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ১৪/১৫টি হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে আমাদের ওপর। আমরা আমাদের অস্তিত্ব ধ্বংসের চক্রান্ত থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাই। এ জন্য প্রয়োজন পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী জাতিসত্তা সমূহকে ধ্বংসের চক্রান্ত প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসার জন্য সচেতন দেশবাসী তথা বিশ্ববিবেকের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। সাথে সাথে বর্তমান নির্বাচিত সরকারের প্রতি আমাদের আশু দাবী-
১। লোগাং ও বালুখালী হত্যাকাণ্ডসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার বিভাগীয় তদন্ত, শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং দোষী ব্যক্তিদের আইনানুগ শাস্তি প্রদান করতে হবে।
২। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের জন্য সংসদীয় কমিটি গঠন করতে হবে এবং সকল প্রকার অনুসন্ধানী দল ও সাংবাদিকদের সফরের অবাধ সুযোগ দিতে হবে।
৩। ভবিষ্যতে যাতে এরূপ মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত না হয় তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
৪। উক্ত দু’টি হত্যাকাণ্ডসহ এ যাবত পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং গুচ্ছগ্রাম ভেঙে দিয়ে স্ব স্ব জায়গা জমিতে পুনর্বাসন করতে হবে।
৫। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ
কেন্দ্রীয় কমিটি
পাহাড়ি গণ পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি
১৪ এপ্রিল ‘৯২