প্রিয় দেশবাসী,
আমাদের সংগ্রামী অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের অশান্ত এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা আপনাদের কম বেশী অজানা নয়। দীর্ঘ কাল যাবৎ এই অঞ্চলের বিরাজমান সমস্যা ও প্রকৃত ঘটনাবলী দেশের কায়েমী স্বার্থবাদী মহল (সরকার) সুকৌশলে ধামা চাপা দিয়ে রেখেছেন। বিভিন্ন বিধি নিষেধ আরোপিত থাকায় দেশের পত্র-পত্রিকা ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যম সমূহে একপেশে ও পক্ষপাত দুষ্ট সংবাদ প্রকাশ হয়ে আসছে। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিগত ৪ঠা মে, ১৯৮৯ ইং তারিখে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার লংগদু উপজেলায় সংঘটিত এক বিভীষিকাময় হত্যালীলার খবর সংবাদ মাধ্যমগুলোর নিরপেক্ষতা ও দায়িত্ব নিষ্ঠা সম্পর্কে আমাদের মনে সংশয় দেখা দিয়েছে। কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠির হাতেই যদি দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য থাকে তাহলে দেশের বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন কোথায় ঘটবে? আমরা সত্যিই উদ্বিগ্ন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের লংগদু হত্যাকাণ্ড নতুন কোন ঘটনা নয়। ১৯৮০ সনের বর্বরোচিত কলমপতি গ্রামের হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে মুভাছড়ি, ফেনী, মাটিরাঙ্গা-টাইনডং, পানছড়ি, ভূষণছড়া, গোরস্থান, ছোট হরিণা, ১৯৮৮ সনের হীরাচর সার্বোতলি, খাগড়াছড়ি একের পর এক সংঘটিত হচ্ছে।
এসব হত্যাকাণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের উচ্ছেদের লক্ষ্যে সরকারের দীর্ঘ পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রেরই অংশ। বে-আইনীভাবে পুনর্বাসিত অনুপ্রবেশকারীদের মধ্য থেকে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভি,ডি,পি) সৃষ্টি করে সরকার পাহাড়ী উচ্ছেদ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন শুরু করেছেন।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার লংগুদু উপজেলয় ৪-৫-৮৯ ইং তারিখে পাহাড়ী অধ্যুষিত এলাকায় বেআইনী অনুপ্রবেশকারী ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী যৌথভাবে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। ঐ পৈশাচিক হামলায় হত্যাকারীরা দা-বলণ্ডম ছাড়াও আগ্নেয়াস্ত্র পর্যন্ত ব্যবহার করেছে। নারী, পুরুষ, শিশু, আবাল-বৃদ্ধ বণিতা কেউ তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এমনকি উপজেলা সদরেও (যেখানে সব ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে) বাবু অনিল বিহারী চাকমা (পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রাক্তন সদস্য, লংগুদু ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, ট্রাইবেল কনভেনশনের প্রাক্তন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান ৩নং লংগুদু মৌজার হেডম্যান) পর্যন্ত এই হামলা থেকে বাদ যায়নি। তিনি ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেও তার স্ত্রী এবং তার বাসভবনে আশ্রয় গ্রহণকারী অনেকেই এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বাবু অনিল বিহারী চাকমা তাঁর স্ত্রীর মৃতদেহ পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে সারারাত পাহারা দিয়ে রাখেন। পরে ভোরের দিকে থানায় ঘটনাটি জানিয়ে উদ্ধার করতে গেলে মৃতদেহগুলোর কোন হদিস পাওয়া যায়নি। পরিস্থিতির এমন ভয়াবহতায় মুহদেহগুলো ধর্মীয় বিধিতে পর্যন্ত সৎকার করা সম্ভব হয়নি। প্রশাসনের পরিকল্পিত নিষ্ক্রিয়তার কারণে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হতে পেরেছে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক হিসাব মতে ২৫ জনের মতো নিহত এবং ৫০ জনের অধিক আহত হয়েছে। আহতদের কিছু সংখ্যক রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। মৃতের সংখ্যা আরও বেশী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
লংগুদু উপজেলার বড় আদাম, মহাজন পাড়া, হলধর কার্বারী পাড়া, আদারকছড়া, ইয়ারেঙ ছড়ি সহ কত পাহাড়ী বসতি যে ছরখার হয়েছে, কত ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি যে ধ্বংস হয়েছে আজো তার সঠিক হিসেব মিলেনি। কত মৃতদেহ যে গ্রামের অলি গলিতে পড়ে আছে তারও হিসেবে মিলেনি। হতভাগ্য পাহাড়ী জনগণ এখন সর্বস্বান্ত, আশ্রয়হীন, স্বজনহারা। নিজেদের আবাসভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে হাজার হাজার পাহাড়ী লোকজন শেষ আশ্রয়ের সন্ধানে গহীন অরণ্য বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকেই প্রতিবেশী দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এতবড় হত্যাকাণ্ডের সরকারীভাবে আজ পর্যন্ত কোন তদন্ত কমিটি গঠিত হয়নি।
লংগুদু হত্যাকাণ্ডের পেছনে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র রয়েছে। উক্ত এলাকায় উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ সরকার অজ্ঞাত নামা আততায়ীর হাতে নিহত হলে, উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনুপ্রবেশকারীরা হত্যালীলার আয়োজন করে। আবদুর রশিদ সরকারের হত্যার পেছনে জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ইতিপূর্বে তার নামে বেশ কয়েকটি মামলা ছিল। তাছাড়া এলাকার উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে অনুপ্রবেশকারীদের মাঝে দ্বন্দ্ব রয়েছে। পরবর্তী উপজেলা নির্বাচনেও এই রশিদ সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সম্ভাবনা ছিল। সম্ভবত তাকে জব্দ করার জন্যই তার প্রতিদ্বন্দ্বি গ্রুপ তাকে সরিয়ে ফেলে। অথচ তার এই হত্যার দায়ভার মিথ্যা ও অযৌক্তিকভাবে পাহাড়ীদের উপর চাপিয়ে দিয়ে তার শোধ নেয়া হলো পাহাড়ীদের রক্তের বিনিময়ে। এই লংগুদু হত্যাকাণ্ড বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিছু নয়। সরকারেরই ষড়যন্ত্রের নতুন সংযোজন মাত্র।
আজ দেশের প্রত্যেকটি নাগরিককে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান অবস্থা সম্পর্কে সচেতন থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।
আসুন আমরা নিম্নোক্ত শ্লোগানের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্যমত গড়ে তুলি–
- লংগুদু হত্যাকাণ্ডে নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং শ্বেতপত্র প্রকাশ সহ দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে।
- পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধন চাই।
- পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারী উদ্যোগে বে-আইনীভাবে পুনর্বাসিত অ-পাহাড়ীদের প্রত্যাহার করতে হবে।
- ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে নুন্যতম দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে নগদ প্রদান সহ যথাযথ পুনর্বাসন করতে হবে।
- ভবিষ্যতে যাতে লংগুদু হত্যাকাণ্ডের ন্যায় ঘটনা না ঘটে তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
- পাহাড়ী ছাত্র/ছাত্রীদের ধরপাকড় ও হয়রানী বন্ধ এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
২১ মে ১৯৮৯ ইং
ঢাকা।
নিবেদক-
বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ