সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্বিচারে হত্যা এবং শিক্ষা ধ্বংসের চক্রান্ত রুখে দাঁড়ান
প্রিয় দেশবাসী,
বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ গভীর সংকটের মুখোমুখী। স্মরণাতীত কাল থেকে শোষিত বঞ্চিত জুম্ম জনগণ এক ক্রান্তিলগ্নে এসে পৌঁছেছে। দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে চলছে অস্ত্রের ঝনঝনানী এবং রক্তপাত। হাজার হাজার নিরীহ জনতার জীবন অকালে ঝরে পড়েছে। পঞ্চাশ হাজারেরও বেশী জুম্ম নরনারী জীবন বাঁচানোর তাগিদে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে এবং হাজার হাজার জুম্ম নরনারী নিজেদের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে বিক্ষিভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে। জুম্মদের জীবনের স্বাভাবিক বিকাশের পথ অন্ধকারে নিমজ্জিত। জীবনের নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত। জুম্ম জনগণের ভাগ্য আজ সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী। এমনকি শিক্ষার মত জন্মগত অধিকার পর্যন্ত ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃক কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত।
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাস্তাঘাট এখনও নিরাপদ নহে। থানছি, রুমা, রোয়াংছড়ি, বিলাইছড়ি, কাপ্তাই, রাজস্থলী, নানিয়াচর, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, লক্ষ্মীছড়ি, গুইমারাসহ প্রত্যন্তাঞ্চলে এখনও সেনাবাহিনীর অত্যাচার চলছে। পূর্বের মত সামরিক অভিযান চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে থানছিড়, রুমা, রোয়াংছড়ি, জুরাছড়ি, রাজস্থলী অঞ্চলে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের হয়রানি করা হচ্ছে এবং হুমকিও দেয়া হচ্ছে। সেনাবাহিনীর এ ধরনের আচরণ মোটেও সহনশীলতার পরিচয় বহন করে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে এখনও মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। থানছিতে জনগণের উপর অত্যাচার এক চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। উৎপাদনের মালামাল বেচা-কেনার উপর কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। রুমায় ছাত্র পরিষদের নেতা কর্মীদের প্রকাশ্য হুমকি দেয়া হচ্ছে। রোয়াংছড়িতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বান্দরবান জেলা শাখার আহ্বায়িকা ওয়াই চিং প্রু মারমাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানি করা হয়েছে। গত ১৭-০৮-৯৪ ইং রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ির জ্ঞান আলো চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে ২৬-০৮-৯৪ ইং লাল রিজাফ বমকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনা শুধু এখানে শেষ নয়। এখনও ছাত্র নেতা কালায়ন চাকমা, লিয়ানদৌ বমসহ অনেকে কারাগারে মানবেতর জীবন যাপন করছে। হাজার হাজার শরণার্থী ভারতের আশ্রয় ক্যাম্প থেকে স্বদেশ ফেরৎ আসছে। সরকার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তাদের জায়গা-জমি ফেরৎ দিচ্ছে না। যাদের পূর্বে চাকুরী ছিল তাদেরকে চাকুরীতে পুনর্বহাল করার প্রতিশ্রুতি থাকলও এখনো পর্যন্ত পুনর্বহাল করা হয়নি। সমস্যা সমাধানের নামে চলছে শুধু কালক্ষেপন। ইতিমধ্যে অনুপ্রবেশকারী বেদখলকৃত পাহাড়ীদের জমি-জমা বন্দোবস্তী দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ কর্তৃক বেদখলকৃত ব্যাপারে সরকারী মহল থেকে সুক্ষ্ম ইঙ্গিত ও ভূমিকা রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের ইনকাম ট্যাক্স আরোপ ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন বিধি লংঘনস্বরূপ। এতে জুম্ম জনগণ স্থানীয় ছোটখাট ব্যবসা-বাণিজ্য, কন্ট্রাক্টরী ও স্থাবর সম্পত্তি হারাবে। এজন্য সকলকে সোচ্চার হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
“শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড”। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি তো দূরের কথা বেঁচে থাকার ন্যূনতম উপায়টুকুও আর অবশেষ থাকে না। শিক্ষাই একমাত্র যেকোন জাতিকে আলোর পথ দেখাতে পারে। সেজন্য শিক্ষাকে হতে হবে স্বাধীন ও সার্বজনীন। শিক্ষা যদি অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কিংবা শৃংখলিত হয় তাহলে কোন মুক্ত বুদ্ধির বিকাশ আশা করা নিষ্ফল মাত্র। আর সেই ষড়যন্ত্র যদি সুদূর প্রসারীভাবে করা হয়ে থাকে তাহলে জাতীয় জীবনে সমূহ বিপদ ডেকে আনে। যেমনিভাবে আজ জুম্ম জনগণের জাতীয় জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনছে। জুম্ম ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষা বিশেষ করে মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কৃষিতে ভর্তি হওয়াটা পুরোপুরি নির্ভর করে ক্যান্টনমেন্টের মর্জির উপর। ভর্তি পরীক্ষায় ভাল ফল পাওয়ার উপর নির্ভর করে না। ক্যান্টনমেন্টের সাথে কতটুকু উঠা-বসার সম্পর্ক রয়েছে তার উপর নির্ভর করে। ফলে যোগ্য প্রার্থীরা ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এতে দু’টি মারাত্মক ক্ষতিকর দিক রয়েছে। যেমন প্রথমতঃ যোগ্য প্রার্থী তার মেধা বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, দ্বিতীয়তঃ অযোগ্য প্রার্থী পাঠ্যসূচীর সাথে তাল মিলাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত পড়াশুনা ইস্তফা দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে।
সংগ্রামী বন্ধুগণ,
বর্তমান সরকার ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। ২০০০ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করতে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অথচ একই সময়ে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা উন্নয়নে নেতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে। উচ্চ শিক্ষা ক্যান্টনমেন্টের হাতে বন্দী। তিন পার্বত্য জেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের খরচে পরিচালিত তিনটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ছাত্রাবাস ইতিমধ্যে কোন অজুহাত ছাড়াই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বান্দরবানে ১২টি প্রাইমারী স্কুল বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়াও বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে অঘোষিতভাবে অনেক প্রাইমারী স্কুল অপ্রত্যাশিত কারণে বন্ধ রয়েছে। প্রত্যন্তাঞ্চলে শিক্ষক এবং শিক্ষার সরঞ্জামের অভাবে অনেক প্রাইমারী স্কুলে পড়াশুনা হচ্ছে না। সরকারের সে ব্যাপারে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। উপরন্তু শিক্ষা সংকোচনের জন্য যা যা করা দরকার তা সরকার করে যাচ্ছে। পূর্বের পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের কোটা (উপজাতীয় কোটা শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্মারক নং শা/১/৫/এম-৪৮/৮৩ শিক্ষা, ১/৪/৮৪ ইং) কে “পার্বত্য কোটায়” পরিণত করে পাহাড়ী বাঙ্গালী কৃত্রিম দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করার জন্য পাঁয়তারা চালিয়ে যচ্ছে। অতি সম্প্রতি জানা গেছে, পার্বত্য কোটাকে আবার জেলা কোটায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। এইভাবে একের পর এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জুম্ম জনগণের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে চিরতরে বিলুপ্ত করার জন্য সরকার এক জঘন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
সংগ্রামী জনতা,
সরকার এবং ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃক জুম্ম জনগণের শিক্ষার অধিকার হরণের অপচেষ্টাকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে “শিক্ষা সপ্তাহ” পালনের ডাক দিয়েছে। আগামী ৮ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ই সেপ্টেম্বর ‘৯৪ ইং পর্যন্ত ৭ দিন ব্যাপী এ সপ্তাহ পালন করা হবে। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে প্রতিটি স্কুল, কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের সাথে মত বিনিময়, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে মতবিনি ময় এবং সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে মতবিনিময় করবে।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের শিক্ষা বিষয়ক এ মহা অভিযানকে সাফল্য মন্ডিত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনসাধারণ, ছাত্র-শিক্ষক, সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তা, কর্মচারী মহলকে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। সাথে সাথে শিক্ষা উন্নয়নের জন্য নিজ নিজ ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার এবং আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আমরা পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের তরফ থেকে পার্বত্যবাসীসহ সমগ্র দেশবাসীকে আহ্বান জানাচ্ছি। শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের “দ্বিতীয় জাতীয় প্রতিনিধি সম্মেলন ৯৩” কর্তৃক সংশোধিত ৫ দফা দাবীনামায় উল্লেখিত শিক্ষা সংক্রান্ত দাবীসমূহ সর্ব সাধারণের জ্ঞাতার্থে নিম্নে উদ্ধৃত করা হল।
১। শিক্ষা ক্ষেত্রে সংরক্ষিত আসন বণ্টনে সামরিক নিয়ন্ত্রণ, হস্তক্ষেপ ও প্রভাবমুক্ত সুস্থ শিক্ষা জীবন নিশ্চিত করণের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট সকল দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে।
২। পাহাড়ীদের জন্য সংরক্ষিত পূর্বের ন্যায় “কোটা” পদ্ধতি চালু রেখে সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। পুরাতন বসতী বাঙ্গালীদের শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজন বোধে তাদের জন্য আলাদা “কোটা” পদ্ধতি প্রবর্তন করা যেতে পারে।
৩। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থাপিত কলকারখানাসূহে ৬০% ভাগ এবং স্থানীয় অফিস আদালতের চাকুরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৮০% ভাগ পাহাড়ীদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে।
৪। বি.এস.এস, সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীতে ভর্তিসহ প্রথম শ্রেণীর সকল সরকারী আধা-সরকারী, বেসরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনগ্রসর পাহাড়ীদের জন্য ১০% কোটা বরাদ্দ করতে হবে।
৫। অবিলম্বে খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান সরকারী কলেজকে পূর্ণাঙ্গ ডিগ্রী কলেজে রূপান্তরিত করতে হবে এবং রাঙ্গামাটি সরকারী কলেজে অনার্স কোর্স চালু করে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ মর্যাদা প্রদান করতে হবে।
উপরোক্ত পরিস্থিতির আলোকে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ সপ্তাহব্যাপী শিক্ষা অভিযান এবং স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। আসুন নিম্নলিখিত শ্লোগান ধারণ করে সংগ্রাম জোরদার করি।
– ছাত্র নেতা কালায়ন চাকমা, লিয়ানদৌ বম সহ সকল বন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে এবং সকল ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
– পূর্বের কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত করার ষড়যন্ত্র সহ শিক্ষা ধ্বংসের চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।
– প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদেরকে জীবনের নিরাপত্তাসহ প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সুষ্ঠু পুনর্বাসন করতে হবে।
– আলোচনার নামে কালক্ষেপন করে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ভেঙ্গে দেয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।
– স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য, কন্ট্রাক্টরী ও স্থাবর সম্পত্তির উপর ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি লংঘন করা চলবে না।
– দালালীপনা, সুবিধাবাদ, আপোষকামীতা, লেজুরবৃত্তি ও বিভেদকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন।
তারিখ: ৬ সেপ্টেম্বর ‘৯৪, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ
কেন্দ্রীয় কমিটি।
কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত এবং প্রচার সম্পাদক কর্তৃক প্রচারিত।