পিসিপি প্রতিষ্ঠার দুই যুগ পূর্তিতে আহ্বান
জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে আসুন, পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হই!
সংগ্রামী সাথী বন্ধুরা,
নিষ্ঠুর সেনা শাসন, দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে একদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে যে লড়াকু সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছিল, আজ ২০ মে ২০১৩– গৌরবদীপ্ত সে-ই পিসিপি প্রতিষ্ঠার দু’যুগ পূর্ণ হল। এ মহিমামণ্ডিত দিনে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে এবং দেশের বাইরে যেখানে যেখানে এ সংগঠনের নেতা-কর্মী অবস্থান করছেন, আমরা তাদের সবাইকে জানাই সংগ্রামী অভিবাদন।
অধিকারহারা নির্যাতিত জনগণের অব্যক্ত ভাবের ভাষা দিতে এবং ন্যায্য দাবি-দাওয়া তুলে ধরতে গিয়ে পিসিপি’র বহু নেতা-কর্মী-সমর্থক সেনা-পুলিশ-আর্ম পুলিশ ও সেটলারের হাতে শহীদ হয়েছেন। প্রতিষ্ঠার এ দিনে আমরা সে-ই সব বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর সন্মান ও শ্রদ্ধা জানাই।

যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও চেতনা নিয়ে ১৯৮৯ সালের ২০ মে আমাদের এ প্রিয় সংগঠন গঠিত হয়েছিল, কালের প্রবাহে তারা সবাই অবিচল অটল থাকতে পারে নি। বিশ্বের অন্যত্র আন্দোলন সংগঠনে যেমন বিচ্যুতি দেখা গেছে, অনেক পরিচিত নেতা-কর্মীর পতনের দৃষ্টান্ত্ম রয়েছে, পিসিপি’তেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। সবাই সঠিক পথ বেয়ে গন্ত্মব্যে পৌঁছতে পারে না। অনেকে মাঝপথে বিচ্যুত হয়, নালা-নর্দমায় পড়ে যায়। যারা সামনে এগুতে চায়, পতিতরা তাদের গতিরোধ করার হীন প্রচেষ্টা চালায়, সক্ষম না হলে বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকে। এতে অতীতে পিসিপি কখনই দমে যায় নি, ভবিষ্যতেও যে কোন বাধা-বিপত্তির মুখে থমকে যাবে না। বিশ্বে নির্যাতিত জনগণের আন্দোলন সংগ্রাম দমন করতে যত রকমের আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র পরিচালিত হয়েছে, পিসিপি’র আন্দোলনেও তাই হবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। এ ব্যাপারে ছাত্র সমাজকে সজাগ হতে হবে।
বন্ধুরা,
পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র সমাজ যাতে সংগঠিত হয়ে নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে, সেনা গোয়েন্দা সংস্থা সে ব্যাপারে ছিল ভীষণ তৎপর। পিসিপি প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই সেনা গোয়েন্দা সংস্থা তথাকথিত ‘লায়ন বাহিনী’ ‘টাইগার বাহিনী’ ‘গণপ্রতিরোধ কমিটি'(গপ্রক)–ইত্যাদি ঠ্যাঙ্গারে বাহিনী গঠন করে দিয়েছিল। খাগড়াছড়ি ও পানছড়িতে সেনাসৃষ্ট এসব ঠ্যাঙ্গারে বাহিনীর দৌরাত্ম্যে পৌঁছেছিল চরমে, জনগণ ছিল অতিষ্ঠ। সেনা গোয়েন্দা চক্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ছাত্র নামধারী একশ্রেণীর কুলাঙ্গারদের নানান সুযোগ সুবিধা দিয়ে বাগিয়ে নিয়েছিল। ছাত্রবেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করলেও এরা সেনা ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত, আন্দোলন বিরোধী নানা তথ্য পাচার করত। ছাত্র নামধারী এ কুলাঙ্গারদের অনেকে জাতীয় অনিষ্ট সাধন করে মাসিক খরচ মিটাত, সেনা ক্যাম্পের অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ফূর্তি করত। এ চক্রটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল ক্যাফেটরিয়ায় ১৯৮৮ সালের ২৪ অক্টোবর তৎকালীন চট্টগ্রাম উপজাতীয় ছাত্র পরিষদের মিটিঙে হামলা করে, ফাইলপত্র ছিনিয়ে নেয়। এ হামলায় তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও বর্তমানে ইউপিডিএফ-এর কেন্দ্রীয় নেতা সচিব চাকমাসহ বেশ ক’জন ঐ ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়েছিলেন। তখনকার দুর্বৃত্তরা রঙ পাল্টিয়ে সমাজে এখন নানা বেশ ধরে রয়েছে, সময়ে তাদের মুখোশ খুলে পড়বে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও ন্যাক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে গেল ১১ মে ২০১৩, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে পোস্টারিং করতে গিয়ে পুলিশের সামনে বর্বর হামলার শিকার হয়েছেন সিমন-তরুণ-জুপিটার-রুবেলসহ পিসিপি’র ছয় জন ছাত্র নেতা। তাদের মধ্যে দর্শন বিভাগের ছাত্র মি. তরুণ বেশ গুরুতর জখম হন, দুর্বৃত্তরা আঙুলের গুটা দিয়ে তার চোখের ক্ষতিসাধন করতে চেয়েছিল। এ বর্বরতা ‘রগ কাটা ও চোখ উপড়ে ফেলার’ মধ্যযুগীয় তা-বের কথা তথা সন্তু লারমার প্ররোচনামূলক সাক্ষাতকারের কথাই মনে করিয়ে দেয়। উক্ত ঘটনার কারণে প্রচলিত আইনে সন্তু লারমা হবেন “হুকুমের আসামি”। পানছড়িতে কুসুমপ্রিয়-প্রদীপ লাল, কাচলঙে বিঝুর দিনে দুই বছরে শিশু অর্পি ও তার বাবা এবং সাম্প্রতিক কালে সুদীর্ঘসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা তিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন শাসকচক্র তাকে আঞ্চলিক পরিষদের গদিতে বসিয়ে রেখেছে। বুঝতে কারোর বাকী থাকে না ‘জুম্মো দিয়ে জুম্মো ধ্বংসের’ ভয়াবহ নীতি বাস্তবায়নের জন্য সন্তু লারমাই হচ্ছেন সরকারের সবচে’ বিশ্বস্ত গুটি।
উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আজ যে নীচ অত্যন্ত ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে, তার পেছনে রয়েছে সরকার ও সন্তু লারমার প্রত্যক্ষ মদদ ও উস্কানি। পুলিশের উপস্থিতিতে সরকারি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের প্রত্যÿ সহায়তায় দুর্বৃত্তরা পিসিপি নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালানোর ঘটনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। নিজের গদি রক্ষার্থে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে বেতনধারী সশস্ত্র দুর্বৃত্ত লেলিয়ে দিয়ে হত্যাকা- চালাচ্ছেন। ছাত্র সমাজকে বিভক্ত করতে একশ্রেণীর ধান্দাবাজদের নানা প্রলোভন দিয়ে টেনে নিয়েছেন। মাঝে মাঝে রাজনীতির মাঠ গরম করতে তিনি ছাত্র নামধারী ধান্দাবাজদের ভাড়া করে থাকেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে হত্যাকা- ও নোংরা ঘৃণ্য রাজনীতির ফেরিওয়ালা হলেন সন্তু। তার থেকে সাবধান হোন!
সংগ্রামী সহযোদ্ধারা,
এ বিশেষ দিনে এটা আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই যে, উদ্ধত রাইফেল-মেশিনগান, অত্যাচারি শাসকের হুমকি, রক্ত চক্ষু তোয়াক্কা না করে দু’যুগ আগে পিসিপি গঠিত হয়েছিল। সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন চক্রটির পথভ্রষ্ট হয়ে আন্দোলন পরিত্যাগ, বিতর্কিত পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন, ছাত্র সমাজে ভাঙ্গনের ষড়যন্ত্র, ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধির প্রলোভনে একশ্রেণীর ছাত্র নামধারী ধান্দাবাজের পক্ষ ত্যাগ ও গরু-ছাগলের মত বিক্রি হয়ে গেলেও, পিসিপি’র মূল নেতৃত্ব কখনই বিচ্যুত হয় নি। শত প্রতিবন্ধকতা, ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার ও হুমকি মোকাবিলা করে সংগঠনকে শক্ত ভিত্তির ওপর গড়ে তুলতে পিসিপি’র মূল নেতৃত্ব দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছেন। আমরা দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করতে চাই, পিসিপি’র সংগ্রামের এ গৌরবোজ্জ্বল পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরার সুমহান দায়িত্ব আমাদের কাঁধে অর্পিত হয়েছে। আমরা এ পতাকা সমুন্নত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
স্বার্থান্বেষী কুটিল রাজনীতির কাদা পাঁকে পড়ে যারা বিচ্যুত হয়েছে এবং সংগঠন ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী ঘৃণ্য অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে, আমরা তাদের তীব্রভাবে ঘৃণা করি, অন্তর দিয়ে ধিক্কার জানাই। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাসে কালিমা লেপন করে যারা ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করছে, তাদের আমরা বেঈমান বিশ্বাসঘাতক মনে করি। তাদের চিহ্নিত করে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ছাত্র সমাজের প্রতি আহ্বান জানাই। যারা না বুঝে অপরাধী চক্রের খপ্পড়ে পড়ে অনুতাপ করছে, আমরা তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আহ্বান জানাই।
যে শিশু একবার জেগে উঠে, তাকে আর ঘুম পাড়ানি গানে ঘুমানো যায় না। পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র সমাজ জেগেছে, তাদের আর হুমকিতে কিংবা প্রলোভনে বশীভূত করা যাবে না। দালাল-প্রতিক্রিয়াশীলদের দৌরাত্ম্যে আমরা ক্ষান্ত হব না। অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চলবে।
সত্য ও ন্যায়ের জয় অনিবার্য!
পূর্ণস্বায়ত্তশাসন একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেই!
পিসিপি’র দু’যুগ পূর্তি সফল হোক!
২০ মে ২০১৩
খাগড়াছড়ি।
বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), কেন্দ্রীয় কমিটি
পিসিপি’র কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত। ২০/০৫/ ২০১৩।