পিসিপি’র ৩ যুগ পূর্তিতে আহ্বান
জাতীয় ঐক্যের পথে বাধা ছাত্রবেশী দালাল, শাসকগোষ্ঠীর লেজুড়, সুবিধাবাদী ও আপোষকামীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন!
আসুন, জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের লড়াই জোরদার করি।
সংগ্রামী বন্ধুরা,
আমাদের প্রাণপ্রিয় সংগঠন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ৩ যুগ আগামী ২০ মে ২০২৫ পূর্ণ করছে। এ ৩৬ বছরে পিসিপি বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে, রাজনৈতিক ঝড়-ঝঞ্ঝার মুখোমুখি হয়েছে এবং শহীদের রক্তে ভেজা পথ অতিক্রম করেছে। জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে বহু নির্ভীক যোদ্ধা আত্মবলিদানের মাধ্যমে আমাদের সংগঠনের পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন ও আদর্শের পতাকা উড্ডীন রেখেছে। প্রতিষ্ঠার এই দিনে আমরা তাঁদের গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি আহত ও পঙ্গুত্ব বরণকারী সকল সহযোদ্ধাদের। কারা-অন্তরীণ সহযোদ্ধাদেরও আমরা সম্মানের সাথে স্মরণ করছি। আরো শ্রদ্ধা নিবেদন করছি সাম্প্রতিক সময়ে দেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের। অধিকার আদায়ের পথ পাড়ি দিতে গিয়ে পিসিপি যাঁদের আন্তরিক সহযোগিতা ও অকুন্ঠ সমর্থন পেয়েছে, দেশে-বিদেশে থাকা সেই সকল শুভাকাঙ্ক্ষী, শুভানুধ্যায়ীসহ দেশবাসীকে প্রতিষ্ঠার এই দিনে আমরা রক্তিম শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
সাথী ও বন্ধুরা,
দেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে থাকা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের এক চরম জাতীয় সংকটের সময়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পরপরই শুরু হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগত পুনর্বাসন, চাপিয়ে দেয়া হয় উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুজিব-জিয়া পাহাড়ে তৈরি করে একের পর এক ক্যান্টনমেন্ট। অপারেশন দাবানল নাম দিয়ে বিদ্রোহ দমনের নামে শুরু হয় নিষ্ঠুর সেনা অত্যাচার দমন পীড়ন। কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরা তখনও বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তারপরও চলতে থাকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ ও জমি বেদখল, বহিরাগতদের হামলা, দাঙ্গা এবং একের পর এক গণহত্যা। সরকার ধামাচাপা দিয়ে যাচ্ছিল একের পর এক লোমহর্ষক ঘটনা। সে সময় জীবনের নিরাপত্তার জন্য একদিকে অর্ধ লক্ষাধিক পাহাড়ি ভারতের ত্রিপুরায় শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন, আর অন্যদিকে নিজ বাস্তুভিটা হারিয়ে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে থাকা-কাপ্তাই বাঁধের পর এ ছিল দ্বিতীয় বড় জাতীয় বিপর্যয়।
১৯৮৩-৮৫ সালের রক্তাক্ত “লাম্বা-বাদি” গৃহযুদ্ধের পর জনসংহতি সমিতির সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন লাম্বা গ্রুপ একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে সক্ষম হলেও, আদর্শিক দৈন্যতা ও দোদুল্যমানতার কারণে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হচ্ছিল। ফলে বলতে গেলে বিনা প্রতিরোধে চলতে থাকে শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক মধ্যযুগীয় বর্বর তান্ডবলীলা। এই প্রেক্ষাপটে রাঙ্গামাটির লংগদুতে ১৯৮৯ সালের ৪ঠা মে সংঘটিত হয় এক ভয়াবহ ও লোমহর্ষক গণহত্যা, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর ছাত্র সমাজ ও সমগ্র পাহাড়ি জনগণকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। অবশেষে ২০ মে বছরের পর বছর ধরে জমতে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৮৯ সালের এদিন ঢাকায় বুয়েটের রশীদ হলে সারাদেশে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে গঠন করে প্রাণ প্রিয় সংগঠন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, যা সংক্ষেপে পিসিপি নামে পরিচিত। পর দিন ২১ মে পিসিপির ব্যানারে লংগদু হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে ঢাকার রাজপথে ঐতিহাসিক প্রথম মৌন মিছিল বের করা হয়। শহীদের রক্ত বীজ থেকে জন্ম নেয়া সংগঠন পিসিপি আজো তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। ধরে রেখেছে তার গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস, লড়াইয়ের চেতনা ও নিপীড়িত জাতির মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
সংগ্রামী সহযোদ্ধারা,
অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর উদ্যত বেয়নেট-মেশিনগান, চোখ রাঙানি, হুমকি-হত্যা, জেল-জুলুমে পিসিপি দমে যায়নি। শাসকগোষ্ঠীর লেজুড়, দালাল, প্রতিক্রিয়াশীল ও ছাত্র লেবাসধারী মাস্তানদের হুমকি, হামলা, অপপ্রচারে পিসিপি দিকভ্রান্ত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে পিসিপি আপোষহীন লড়াইয়ে অবিচল রয়েছে। পিসিপি আত্মপ্রকাশের দিনই তৎকালীন স্বৈরাচারী এরশাদশাহীর চাপিয়ে দেয়া জেলা পরিষদ ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধানের দাবি জানিয়েছিল। এ লক্ষ্যে ‘৯২ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ অভিমুখে পদযাত্রা সহকারে স্পীকারের কাছে ৫ দফা সম্বলিত দাবিনামা পেশ করা হয়েছিল। ‘৯২ সালের ১০ এপ্রিল লোগাঙে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্মরণকালের ভয়াবহ গণহত্যার প্রতিবাদে ২৮ এপ্রিল খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের কড়ইতলা হতে পিসিপির ডাকে হাজার হাজার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সেনাদের সকল রক্ত চক্ষু ও বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা লোগাং অভিমুখে পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। তারা হত্যাযজ্ঞস্থল লোগাঙ পোড়া ভিটায় অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে পুস্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শহীদদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান জানায়। রাঙামাটিতে পিসিপির ৩য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে এই সংগঠনের পক্ষ হতে প্রথমবারের মত স্বায়ত্তশাসনের ডাক দেয়া হয়েছিল।
১৯৯৪ এর ১০ ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথমে খাগড়াছড়ি এবং পরে ’৯৫ সালের ১৫ মার্চ বান্দরবানে ও ’৯৯ সালে ২৪শে জানুয়ারি লক্ষ্মীছড়িতে প্রশাসনের অন্যায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আমাদের এই লড়াকু সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রামের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। রাষ্ট্রীয় অন্যায় দমন পীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার উত্তাল আন্দোলনের প্রবল ঝড়ো-হাওয়া লেগেছিল আলুটিলা থেকে চিম্বুক, ধুধুকছড়া থেকে থানচি পর্যন্ত। ‘৯৭ এর ১০ মার্চ পিসিপি, পাহাড়ি গণ পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাথে যৌথভাবে ঢাকার প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন দাবি উত্থাপন করেছিল। পরে ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জনসংহতি সমিতির (সন্তু লারমা) অস্ত্র সমর্পন অনুষ্ঠানে কালো পতাকা প্রদর্শন করে বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদ জানায়। খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে হাজার হাজার জনতার সম্মুখে ‘No Full Autonomy, No Rest’ ব্যানার তুলে ধরে। এরপর পাহাড়ি জনগণের প্রকৃত অধিকার পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নতুন পার্টি ইউপিডিএফ গঠন হলে পিসিপি তাতে শরীক হয়।
স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের পাশাপাশি পিসিপি মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার আদায়ের জন্যও সংগ্রাম চালায়। শিক্ষা সংক্রান্ত ৫ দফা দাবিতে ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০২-এ শিক্ষামন্ত্রী, ২০০৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট, আন্দোলন, অবরোধসহ পিসিপি’র ধারাবাহিক কর্মসূচি ও দাবির মুখে সরকার ৫ দফা বাস্তবায়নের আশ্বাস দেয় এবং সর্বপ্রথম ২০১৭ সালে ৫টি জাতিসত্তার মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নেয়। শিক্ষা সংক্রান্ত ৫ দফার পরির্প্ণূ বাস্তবায়নে পিসিপি এখনো লড়াই সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে।
সংগ্রামী ছাত্রসমাজ,
বাংলাদেশে গত বছর জুলাইয়ে সূচিত কোটা সংস্কার আন্দোলন আগস্টে এসে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে রূপ নেয়। সারাদেশে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও মধ্যবিত্ত জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণে তা এক গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। অভ্যুত্থানে ‘এক হাজারের অধিক মানুষ নিহত ও ২০ হাজারের অধিক আহত হয়। স্বৈরাচারী হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। অভ্যুত্থানের ঢেউ পার্বত্য চট্টগ্রামেও আছড়ে পড়ে। ‘সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে হাজার হাজার পাহাড়ি শিক্ষার্থী পাহাড়ের দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রীয় শোষণ-বঞ্চনা এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাত অবসান ঘটানোর স্বপ্ন নিয়ে রাজপথে বেরিয়ে আসে। পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানায়।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ভীত হয়ে পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের এই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে একের পর এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ইউপিডিএফ’র তকমা লাগিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনী মদদপুষ্ট ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীদের দিয়ে সমন্বয়কদের তুলে নিয়ে গিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শন এবং আন্দোলন করলে হত্যার হুমকি এবং ‘সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে সভা-সমাবেশ বন্ধ করে দেয়। এমনকি জনসংহতি সমিতি (সন্তু) শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে ইউপিডিএফ’র দ্বারা পরিচালিত বলে আখ্যা দেয় এবং ছাত্রদের আন্দোলনে তীব্রভাবে বাধা প্রদান করে। এক কথায় ১৯৯০ দশকের পর ২০২৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠছিল, সেনা-শাসকগোষ্ঠী জনসংহতি সমিতির সন্তু গ্রুপ ও ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীদের দিয়ে তা ধ্বংস করে দেয়।
প্রিয় বন্ধুরা,
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে এবং আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র সমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে পাহাড়ে ছাত্র সমাজ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ‘২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে অংশগ্রহণ পিসিপি এবং পাহাড়ের ছাত্র সমাজের জন্য অত্যন্ত সম্মান ও গৌরবের বিষয়। ছাত্র-জনতার গণভবন দখলে নেওয়ার ঐতিহাসিক দিনের সাক্ষী পিসিপিও। ১৬ জুলাই ‘২৪ রংপুরে পুলিশ গুলি করে আবু সাঈদকে হত্যা করলে তার প্রতিবাদে ১৭ জুলাই খাগড়াছড়ি শহরে পিসিপির বিক্ষোভ মিছিল ও ২১ জুলাই পানছড়িতে কালো পতাকা মিছিল আয়োজন করা হয়। এছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রাম, রাবি, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পিসিপি’র নেতৃত্বে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা রাজপথে সক্রিয় ছিল। পিসিপি জোটগতভাবেও ফ্যাসিস্ট বিরোধী কর্মসূচিতে অংশ নেয়। আমাদের শরীক সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট আওয়ামী ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লড়াইয়ে দীর্ঘদিন ধরে মাঠে ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাস, দখলদারিত্ব ও স্বৈরাচারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পিসিপি সমতলে জাতীয় ছাত্র সংগঠনের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলে লড়াই করেছে। চব্বিশে হাসিনার পাতানো নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৭টি ভোটকেন্দ্র ছিল ভোট শূন্য, তাতে ইউপিডিএফ’র সাথে সহযোগি সংগঠন পিসিপিরও ভূমিকা ছিল।
ক্ষমতায় থাকার সময় ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরদের দিয়ে পিসিপি ও তার সহযোগি সংগঠনের নেতা-কর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী-সমর্থকদের ওপর অবর্ণনীয় দমন-পীড়ন চালায়। অনেক নেতা-কর্মী খুন, গ্রেপ্তার, জেলে আটক ও নির্যাতনের শিকার হয়। ’২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর পানছড়িতে সেনা মদদপুষ্ট নব্যমুখোশ সন্ত্রাসীরা নির্বিচারে গুলি করে সাবেক ছাত্রনেতা বিপুল চাকমা, সুনীল ত্রিপুরা, লিটন চাকমা ও রুহিন বিকাশ ত্রিপুরাকে হত্যা করে। ’১৮ সালের ৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি শহরে দিনে দুপুরে প্রকাশ্যে খুন করা হয় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি ও ইউপিডিএফ সংগঠক মিঠুন চাকমাকে, একই বছর ১৮ আগস্ট স্বনির্ভর বাজারে পুলিশের সামনে নির্বিচারে ব্রাশ ফায়ার করে খুন করা হয় পিসিপি নেতা তপন-এল্টন ও যুব নেতা পলাশসহ ৭ জনকে। ’১৯ সালের ৯ এপ্রিল গুম করা হয় মাইকেল চাকমাকে, হাসিনা পতনের পরে তাঁকে ‘আয়নাঘর’ থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল সেনাবাহিনী কর্তৃক ছাত্রনেতা রমেল চাকমাকে নির্মমভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। কিন্তু অত্যাচারী হাসিনা সরকারের শেষ রক্ষা হয়নি। জনগণ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে হাসিনাকে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে।
প্রতিবাদী ছাত্রসমাজ,
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হলেও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ হয়নি। গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ করে রাষ্ট্রের প্রকৃত গণতান্ত্রিক রূপান্তর সাধন করা। জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু হাসিনার পতনের ৯ মাস অতিক্রম হলেও এদেশের মানুষের আকাক্সক্ষা এখনো পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। হাসিনা আমলের মতো শাসন ব্যবস্থা অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো সেনা শাসন জারি রাখা হয়েছে। আন্দোলন দমনের নামে সমতলে শিক্ষার্থী, শ্রমিক, নারীদের ওপর পুলিশের আক্রমণ, গুলি ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ ১১টি কমিশন গঠন করলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বরং হাসিনা পতনের পর গত বছর ১৯-২০ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সেনা-সেটেলার বাঙালির যৌথ হামলায় ৪ জন নিহত, অর্ধ শতাধিক আহত এবং পাহাড়িদের দুই শতাধিক ঘর-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, লুটপাট ও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ১ অক্টোবর খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে একটি অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যর ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ি শহরে সেটলাররা পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। এসব হামলার নেপথ্যে নাটের গুরু ছিলেন খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমান্ডার শরীফ মো. আমান হাসানসহ ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তাঁদের নির্দেশে ১৯ সেপ্টেম্বর বিকালে দীঘিনালায় ধনরঞ্জন চাকমাকে এবং একই দিন রাতে খাগড়াছড়ি সদরে সেনারা গুলি চালিয়ে জুনান চাকমা ও রুবেল ত্রিপুরাকে হত্যা করে। ২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটির বনরূপায় বহিরাগত সেটেলার বাঙালিরা দিনে দুপুরে শিক্ষার্থী অনিক চাকমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই ঘটনার ওপর সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন গত ১৪ অক্টোবর ২০২৪ জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তা প্রকাশ করা হয়নি।
গেল এপ্রিলে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈ-সা-বি’তে চাকমাদের ফুল বিঝুর দিনে খাগড়াছড়ির খবংপুজ্যা এলাকায় চেঙ্গী নদীতে ফুল গোজানো (নিবেদন) অনুষ্ঠানে জুনান-রুবেল’র হত্যাকারী শরীফ মো. আমান হাসান উপস্থিত হলে খাগড়াছড়ির জনগণ সেই ফুল গোজানোর স্থান ত্যাগ করে তাকে বয়কট করে। একই স্থানে পার্বত্য চট্টগ্রামে পক্ষপাতদুষ্ট হলুদ সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ব্যানার টাঙিয়ে দেয় খাগড়াছড়ির তরুণ সমাজ। উৎসবের দিনে ছাত্র-যুব সমাজ ও জনতার এমন সাহসী ভূমিকা প্রতিরোধ-সংগ্রামে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই ঘটনা ’৯২ সালে লোগাঙ গণহত্যার প্রতিবাদে খাগড়াছড়িবাসীর বৈসাবি’তে রান্না করা ‘পাজন’ (হরেক রকম সবজির মিশ্রণে রান্না করা তরকারি) চেঙ্গী নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
সংগ্রামী তারুণ্য,
হাসিনার পতনের পর ড. ইউনূস সরকারের মেয়াদ নয় মাস অতিক্রম করলেও দেশ এখনো রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল। দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। মব লেলিয়ে দিয়ে হত্যা, নারীদের হয়রানি, হেনস্তা, ধর্ষণ, হত্যা ও চোর-ডাকাতির মতো ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। সরকার এসবের নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সেনাবাহিনীকে গত ৯ মাস ধরে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে রাখলেও পুলিশসহ বেসামরিক প্রশাসনকে এখনো পুরোপুরি কার্যকর করতে পারেনি সরকার। ন্যায্য পাওনার দাবিতে বিক্ষোভরত ছাত্র-শ্রমিকদের উপর সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। গত কিছুদিন আগে কুমিল্লায় আন্দোলনররত পলিটেকনিক্যাল ছাত্র এবং সুনামগঞ্জে মেডিকেল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের উপর সেনাদের লাঠিচার্জ ছিল নৃশংস ও অমানবিক, যা পার্বত্য চট্টগ্রামে চলা সেনাদের বুটের তলায় পিষ্ট বিপর্যস্ত জনজীবনকে মনে করিয়ে দেয়।
অপরদিকে বান্দরবানে সন্ত্রাস দমনের নামে বম জাতিসত্তার শতাধিক নারী-শিশু ও পুরুষকে এক বছরের অধিক সময় ধরে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। হাসিনার আমলে এক হাজারের অধিক বম জাতির লোকজন ভারতের মিজোরামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। বর্তমান সরকারও তাঁদের ফিরিয়ে আনার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। গত ৫ মে বান্দরবানের থানচিতে খেয়াং জাতিসত্তার এক নারীকে গণধর্ষণের পর মাথা থেঁতলে দিয়ে ও চোখ উপড়ে ফেলে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনায় বাঙালি পর্যটক জড়িত থাকতে পারে বলে ভিকটিমের পরিবার ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এছাড়াও লক্ষ্মীছড়ি, মাটিরাঙ্গা, রামগড়সহ রাঙামাটি ও বান্দরবানে সেটলার কর্তৃক নারী ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনা বেড়ে চলেছে।
অতীতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমাকে লে: ফেরদৌস গং কর্তৃক অপহরণ, বিলাইছড়িতে ২ মারমা সহোদরা কিশোরীকে সেনা সদস্য কর্তৃক ধর্ষণ-নিপীড়ন, কৃত্তিকা-সবিতা-তুম্রাচিং-ভারতীকে ধর্ষণের পর হত্যার যেসব ঘটনা ঘটেছে তার কোন বিচার হয়নি। ফলে পাহাড়ে এসব ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারীদের ওপর এ ধরনের কাঠামোগত সহিংসতা জাতিগত নিপীড়ন ও আধিপত্যেরই বহিঃপ্রকাশ এবং শাসকগোষ্ঠীর এথনিক ক্লিনজিং নীতির অংশ।
সুপ্রিয় ভাই-বোনেরা,
যুগে যুগে দেশে দেশে শাসকের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। মুক্তিকামী জনতার স্রোতকে শাসকগোষ্ঠী আটকিয়ে রাখতে পারেনি। বাস্তিলদুর্গ দিয়ে ফ্রান্সের বিপ্লব আটকানো যায়নি, গুয়াতেমালার কারাগার বিপ্লবীদের ভয় দেখাতে পারেনি, হাজার হাজার নাফাম বোমা ও অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র দিয়ে দেশপ্রেমিক ভিয়েতকং গেরিলাদের পরাজিত করা যায়নি, বরং সায়গন থেকে আমেরিকার সৈন্য ও তাঁবেদারদের লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে। জুলাইয়ে এক হাজারের অধিক মানুষ হত্যা করেও ফ্যাসিস্ট হাসিনা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে রুখতে পারেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিকামী মানুষ রুখে দাঁড়ালে শাসকগোষ্ঠী শত শত সেনা ক্যাম্প-মারণাস্ত্র কিংবা স্ব-জাতীয় দালাল, লেজুড় ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দিয়ে কিছুই করতে পারবে না। গত শতকের নব্বই দশকের উত্তাল ছাত্র-গণজাগরণ তারই সাক্ষ্য বহন করে। আজ হোক কিংবা কাল নিপীড়িত জুম্ম জনগণ ঐতিহাসিক নিয়মে রুখে দাঁড়াবেই। ইতিহাসে জনতার বিজয় অনিবার্য হয়ে থাকে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট আমাদের আহ্বান:
১. পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানের জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করুন।
২. পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা শাসন ‘অপারেশন উত্তরণ’ প্রত্যাহারপূর্বক সাধারণ পাহাড়িদের হয়রানি বন্ধ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করুন।
৩. বান্দরবানের থানচিতে খেয়াং নারীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার ও বিচার করুন। সারাদেশে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।
৪. জাতিসংঘকে অন্তর্ভুক্ত করে জুলাই গণহত্যাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল গণহত্যার তদন্ত, বিচার ও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করুন।
৫. জুনান, রুবেল, ধনরঞ্জন হত্যার নির্দেশদাতা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ মো. আমান হাসানসহ ঘটনায় জড়িত সেনা সদস্য ও অনিক চাকমাকে হত্যাকারী সেটেলারদের গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে দিন। হামলায় নিহত পরিবার ও আহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন করুন।
৭. ইউপিডিএফ নেতা আনন্দ প্রকাশ চাকমাসহ কারাগারে আটক নেতা-কর্মীদের এবং বম জাতির নারী ও শিশুদের মুক্তি দিন।
৮. সকল জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। পিসিপি’র মৌলিক দাবি পাঁচ দফা বাস্তবায়ন এবং শিক্ষা সংক্রান্ত ৫ দফা পূর্ণবাস্তবায়ন করুন।
৯. ডাকসুসহ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচন দিন। সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেনা-গোয়েন্দা নজরদারি বন্ধ করুন।
১১. পতিত সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে জারি করা দমনমূলক ‘১১ নির্দেশনা’ বাতিল করুন এবং সেনাবাহিনীর সৃষ্ট ঠ্যাঙাড়ে মুখোশ বাহিনী ভেঙ্গে দিন।
পিসিপি’র ৩ যুগ পূর্তিতে ছাত্র সমাজের কাছে আমাদের আহ্বান:
* আসুন, জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলি।
* দালাল, সুবিধাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল ও শাসকগোষ্ঠীর লেজুড়দের দৌরাত্ম্য রুখে দিতে ঐক্যবদ্ধ হোন।
* ছাত্রবেশী দালালদের মুখোশ খুলে দিন।
* পিসিপি’র গৌরবোজ্জ্বল লড়াইকে উর্ধ্বে তুলে ধরুন। পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের পতাকাতলে সামিল হোন।
বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)
বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত। ১৫ মে ২০২৫

