পার্বত্য চট্টগ্রামে তথাকথিত বনায়নের নামে পাহাড়ী উচ্ছেদ অভিযানসহ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রতিবাদে আমাদের জরুরী বিবৃতি

May 9, 2025

By: pcpchtor

 

পার্বত্য চট্টগ্রামে তথাকথিত বনায়নের নামে পাহাড়ী উচ্ছেদ অভিযানসহ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রতিবাদে আমাদের জরুরী বিবৃতি

 

প্রিয় দেশবাসী,

আপনারা আমাদের সংগ্রামী অভিবাদন গ্রহণ করুন।

এটা আজ পরিষ্কার যে সামরিক স্বৈরশাসনের পতন হলেও দেশে নতুন কায়দায় গণতান্ত্রিক লেবাসে এখনো স্বৈরাচারী শাসন চলছে। ছাত্রসমাজসহ দেশের আপামর জনগণের মৌলিক দাবী পূরণ করাতো দূরের কথা, বরং বর্তমান সরকার বিভিন্নভাবে গণবিরোধী নীতি অনুসরণ করে চলেছে। চরম অরাজকতার মধ্য দিয়ে আজ দেশ চলছে। জনগণ নিদারুণ দূরাবস্থায় দিনাতিপাত করছে।

দেশের সর্বদক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আরো করুণ। আরো ভয়াবহ। দেশ রক্ষার নামে সামরিক বাহিনী কর্তৃক হত্যা, গুম, ধর্ষণ, শারিরীক নির্যাতন, জেল জুলুম, হয়রানী এবং কোটি কোটি টাকার অপচয় ইত্যাদি এখনো নিত্যদিনের ঘটনা। এই সবের পাশাপাশি পাহাড়ী জনগণকে নিজেদের ভিটেমাটি থেকে চিরতরে উৎখাত করার জন্য চলছে একের পর এক সুগভীর সরকারী ষড়যন্ত্র। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলায় তথাকথিত সংরক্ষিত বনভূমি গঠনের নামে এক লক্ষ আশি হাজার পাহাড়ীকে উচ্ছেদ করার হীন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাঙ্গামাটি জেলার ছয়টি উপজেলার (বর্তমানে থানা) ৩৫টি মৌজার ৮৬ হাজারের অধিক একর খাগড়াছড়ি জেলাধীন ৪টি উপজেলার ৩৭.৩৮৭.৫ একর এবং বান্দরবান জেলার ৭,৩৮৯.২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। ফলে উক্ত এলাকায় পঞ্চাশ হাজার পরিবার তাদের জায়গা-জমি হারাবে। নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাবে। এর দরুন অর্থনৈতিক সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য অঞ্চলের উপরও পড়বে।

 

সচেতন জনতা,

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী জনগণকে নিজের মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়। কখনো শিল্পায়নের নামে, গালভরা উন্নয়নের নামে কিংবা তথাকথিত পুনর্বাসনের নামে একের পর এক উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের ফলে এক লক্ষ লোক তাদের জায়গা-জমি থেকে চিরতরে উচ্ছেদ হয়েছিল। এর মধ্যে ৬০ হাজার পাহাড়ী জীবিকার সন্ধানে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এরপর পার্বত্য চট্টগ্রামে বেআইনীভাবে বাঙালী অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে নতুনভাবে আবার পাহাড়ী উচ্ছেদে অভিযান শুরু হয়। জোরপূর্বক পাহাড়ীদের জমি জবরদখল করে তা বাঙালীদের মধ্যে বিতড়ন করা হয়। পাহাড়ীদেরকে তাদের নিজ ভিটেবাড়ী থেকে উচ্ছেদ করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে চালানো হয় একের পর এক বর্বর গণহত্যা। তথাকথিত উন্নয়নের নামে নিজেদের জায়গা-জমি থেকে বিতাড়িত করে গুচ্ছগ্রাম, শান্তিগ্রাম, বড়গ্রাম, যৌথ খামার নামক বন্দীশিবিরে জড়ো করা হয়। সম্প্রতি সরকারের তথাকথিত সংরক্ষিত বনাঞ্চল গঠনের সিদ্ধান্তও পাহাড়ী জনগণকে উচ্ছেদ করার নগ্ন ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছু নয়।

 

সংগামী জনতা,

বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার সুস্পষ্টভাবে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের ঘৃন্য নীতি অনুসরন করে চলেছে। পার্বত্য জনগণের দাবী ও আশা-আকাঙ্খাকে বারবার পদদলিত করা হচ্ছে। পাহাড়ী জনগণসহ দেশের আপামর জনগণের দাবী সত্বেও স্বৈরাচারী এরশাদ সৃষ্ট গণবিরোধী জেলা পরিষদকে বাতিল না করে বরং তাকে আরো শক্তিশালী ও স্থায়ী করার ষড়যন্ত্র চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে সংসদে আলোচনার ভিত্তিতে সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠনের বিরোধী দলীয় দাবীকে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং একতরফাভাবে স্বৈরাচারী কায়দায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে।

 

প্রিয় জনতা,

পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশাসনসহ জনজীবনের সর্বত্র সামরিক নিয়ন্ত্রণের কথা আপনাদের অজানা নয়। শিক্ষা ক্ষেত্রেও রয়েছে কঠোর নিয়ন্ত্রণ। পাহাড়ী ছাত্র সমাজ বর্তমানে সামরিক বাহিনীর বহুমুখী নির্যাতন ও হয়রানীর শিকার। চট্টগ্রামের G.O.C (জেনারেল অফিসার্স কমান্ডিং) এর ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপরই নির্ভর করে পাহাড়ী ছাত্রছত্রীদের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যত। পশ্চাদপদ জাতিগোষ্ঠী হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী ছাত্রছাত্রীদের জন্য দেশের উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে কিছু-সংখ্যক আসন সংরক্ষিত হয়ে আসছে। এই সব সংরক্ষিত আসন সমূহ বন্টনের পুরো মালিকই হচ্ছে চট্টগ্রামের G.O.C। তিনি কিসের ভিত্তিতে এসব সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দেন তা কেউ জানতে পারে না। সম্প্রতি “উপজাতীয় কোটা” লংঘন করে দেশের মেডিক্যাল কলেজে ১৯৯১-৯২ শিক্ষাবর্ষে ১ম বর্ষ এম.বি.বি.এস ক্লাশে ভর্তির জন্য সংরক্ষিত ১২টি আসনের মধ্যে দুইটিতে অপাহাড়ী ছাত্রকে অবৈধভাবে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এই মনোনয়ন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের জন্য সরকারের শিক্ষা সংকোচন নীতিরই নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।

 

সংগ্রামী জনতা,

বর্তমানে দেশের সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল, জোট, ছাত্র সংগঠন, লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী তথা সর্বস্তরের জনগণ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দাবী জানাচ্ছেন। ক্ষমতাসীন বি.এন.পি সরকার রাজনৈতিক সমাধানের কথা বললেও এখনো নানা তালবাহানা ও ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের দশ ভিন্ন ভাষা-ভাষী পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর জাতীয় অস্তিত্ব আজ চরম হুমকীর সম্মুখীন। তাই এদেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল, জোট, ছাত্র সংগঠন, কৃষক, শ্রমিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী তথা আপামার জনগণের কাছে আমাদের আবারো আহ্বান:-

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা

* রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সোচ্চার হোন।

* পাহাড়ী জাতিসত্তা ধ্বংসের চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।

* সামরিক দমন-পীড়ন ও নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানান।

* বনায়নের নামে পাহাড়ী উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। জনমত গড়ে তুলুন।

পরিশেষে সরকারের নিকট আমাদের জোর দাবী:

* অচিরেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সংরক্ষিত বনাঞ্চল গঠনের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।

* যোগাযোগ মন্ত্রী অলি আহমদের নেতৃত্বে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক কমিটিকে একটি সংসদীয় সাব কমিটি করতে হবে।

* উপজাতীয় কোটা পদ্ধতি নিয়ে তালবাহানা বন্ধ করতে হবে।

* পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান স্বায়ত্তশাসন প্রদানের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে অচিরেই আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে।

* পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের পাঁচ দফা বাস্তবায়ন করতে হবে।

 

১২ই আগষ্ট, ১৯৯২ ইং

ঢাকা।

কেন্দ্রীয় কমিটি

পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ