কল্পনা অপহরণের অর্ধযুগ
অবিলম্বে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে আসুন পাহাড়ে ও সমতলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন জোরদার করি
সংগ্রামী সাথী বন্ধুরা,
যে অপহরণ ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামের নির্যাতিত জনতার সাথে দেশের সমতলের প্রতিবাদী বিবেককে এক কাতারে সম্মিলিত করে, সেই চাঞ্চল্যকর কল্পনা চাকমাকে অপহরণের ছয়টি বছর অর্থাৎ পুরো অর্ধযুগ পূর্ণ হচ্ছে আজ ১২ জুন ২০০২।
‘৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র সাত ঘন্টা পূর্বে দিবাগত রাতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদিকা কল্পনা চাকমা নিজ বাড়ী রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ির নিউ লাল্যঘোনা হতে অপহৃত হন। স্থানীয় কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের অধিনায়ক লেঃ ফেরদৌস এই ঘৃণ্য ন্যাক্কারজনক অপহরণের হোতা।
প্রতিবাদী ভাই-বোনেরা,
সে সময় কল্পনা চাকমাকে অপহরণের প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও বলতে গেলে পুরো দেশে এক ঝড় উঠে। রাজধানী ঢাকা ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন এগিয়ে আসে। নারী সংগঠনের বন্ধুরা এতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মি ও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা প্রতিবাদে সামিল হন। এ ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসকগোষ্ঠির পরিচালিত দমন-পীড়নের প্রতিবাদে জাতীয় বিবেক সোচ্চার হয়ে উঠে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণও যে এ দেশের নাগরিক, কল্পনা অপহরণের পর তা প্রমাণিত হয়েছিলো। পাহাড়ের ও সমতলের জনতা অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদে সেই প্রথমবারের মতো একাত্ম হতে পেরেছিলেন।
পত্র-পত্রিকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্য অনেক ঘটনার চাইতে কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনা সবচেয়ে বেশী আলোচিত হয়। সারা দেশের জনগণ এ ন্যাক্কারজনক ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হন। দেশের বাইরেও কল্পনা অপহরণ একটি ইস্যুতে পরিণত হয়। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামি সরকার কল্পনা অপহরণের ব্যাপারে তদন্ত কমিটি করতে বাধ্য হয়। ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ সত্ত্বেও আওয়ামি সরকারের আমলে ঐ তদন্ত রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি। চিহ্নিত অপহরণকারী লেঃ ফেরদৌস ও তার দোসরদের বিরুদ্ধেও শেখ হাসিনার সরকার কোন আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়নি।
ক্ষমতা থেকে পতিত হবার পরও কল্পনা অপহরণের ব্যাপারে আজ পর্যন্ত শেখ হাসিনা মুখে কলুপ এঁটে বসে রয়েছেন। তখনকার বিরোধীদলের নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও কল্পনাকে উদ্ধারের ব্যাপারে টু শব্দটি করেননি। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হাবিবুর রহমানের মতো একজন প্রাজ্ঞ বিচারপতিও অপহরণের ব্যাপারে প্রশ্ন উদ্রেককারী নিরবতা পালন করে চলেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যতম সদস্য ড: ইউনুস ক্ষমতায় থাকাকালে কল্পনা অপহরণ ঘটনাকে “হৃদয়ঘটিত ঘটনা” বলে ধামাচাপা দেয়ার মতো কান্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তারপর থেকে ড: ইউনুস উদ্ভাবিত “হৃদয়ঘটিত ঘটনার” শিকার কল্পনা চাকমার হদিশ আজ অর্ধযুগ পরও মিললো না। ইউনুস সাহেবও হতভাগীনি মাকে কল্পনার সন্ধান দিতে পারেননি। তখনকার সেনাপ্রধান লেঃ জেনারেল মাহবুবুর রহমান, তখনকার চট্টগ্রামের ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি লেঃ ফেরদৌসের মতো এক চিহ্নিত অপরাধীকে রক্ষা করতে রাঙ্গামাটিতে হেলিকপ্টার হতে প্রচারপত্র ছেড়ে কল্পনা চাকমার সন্ধানদাতাকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণার মতো উদ্ভট কান্ডকারখানা করেন।
সবচেয়ে ঘৃণ্য প্রতিক্রিয়াশীলতা ও বেঈমানীপনার ন্যাক্কারজনক সাক্ষর রাখেন জনসংহতি সমিতির আত্মসমর্পণকারী নেতা সন্তু লারমা। ‘৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান শেষে তিনি প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ‘লোগাঙ হত্যাযজ্ঞ ও কল্পনা অপহরণ ঘটনাকে বিতর্কীত’ বলে আখ্যায়িত করার চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছিলেন। তার জন্য সন্তু লারমা আজ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্ভাগা জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। ঐ ধৃষ্টতাপূর্ণ প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্যের জন্য সন্তু লারমাকে জনতার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ক্ষমা ভিক্ষে করতে হবে।
সংগ্রামী বন্ধুগণ,
সারা দেশ জুড়ে চলছে অন্যায় আর অরাজকতা। এ নারকীয় অরাজকতার শিকার কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণই নন, দেশের সাধারণ মানুষও এর ভুক্তভোগী। দেশে শাসন ক্ষমতার গদিতে কেবল লোকের বদল হচ্ছে। কখনো আওয়ামি লীগ আবার কখনো বিএনপি পালাক্রমে ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হচ্ছে। কিন্তু দেশের সাধারণ জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। দেশ রসাতলে যাবার পেছনে দায়ী হচ্ছে এই শাসকচক্র। এদের সাথে বিতর্কীত ‘চুক্তি’র মধ্য দিয়ে যুক্ত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আত্মসমর্পণকারী সন্ত্র লারমার । নিজেদের ক্ষমতা ও স্বার্থ হাসিলের লক্ষে এরা সাধারণ নিরীহ মানুষকে বলি দেয়। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের এক চক্র সম্ভাবনাময়ী প্রতিভাবান নেত্রী কল্পনা চাকমা এদের স্বার্থের বলি হয়ে অপহৃত হয়েছেন।
আসুন বন্ধুরা:
- আমরা কল্পনা চাকমা অপহরণ তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ ও চিহ্নিত অপহরণকারী লেঃ ফেরদৌস ও তার দোসরদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন জোরদার করি।
- পাহাড়ে ও সমতলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হই
- সম্মিলিত লড়াইয়ে শরীক হয়ে পাহাড়ি-বাঙালি জনগণের ঐক্য ও সংহতি রচনা করি
হিল উইমেন্স ফেডারেশন : পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি)
হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) যৌথ প্রচার ও প্রকাশনা সেল কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত। ১২/৬/২০০২